আয়নামহল (পর্ব-১)

আয়নামহল (পর্ব-১)
-সঞ্জয় গায়েন

 


গাঁয়ের মেলায় মেয়ে সাজানো,
মামি বলল লোক হাসানো

 

আমি তখন বছর দশেক কি বছর এগারো হব। সঠিক মনে নেই। প্রাইমারী স্কুল ছেড়ে হাইস্কুলে পড়ছি। এটুকু মনে পড়ে। তো সেই সময় আমাদের গাঁয়ে বৈশাখ মাসে বড় করে গোষ্ঠমেলা হত। আর সেই মেলায় গাজন হত। গাজন গান নয়, শুধু গাজন। সঙ সাজানো। গাঁয়ের ছেলে মেয়েদের রাধা, কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, অর্জুন,ভীম, রাম, সীতা এসব সাজিয়ে ভ্যানে দাঁড় করিয়ে ঘোরানো হত মেলার মাঠে। চুনকালি মাখিয়ে যাহোক করে সাজানো হত না কিন্তু। রীতিমতো বাইরে থেকে ভালো মেকআপ ম্যান আসতো। গাড়ী ভর্ত্তি করে কত্ত ড্রেস আসতো। সে এক এলাহি ব্যাপার। আর তা দেখতে উপচে পড়তো ভীড়। সঙ সাজানোর পর কেউ কিন্তু সঙ বলে হাসাহাসি করত না। সবাই বলত, জীবন্ত ঠাকুর। দু’ হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করত কতজন।
সেই মেলায় আমিও সঙ সাজতে গিয়েছি। পাড়ার দাদারা বলে গিয়েছিল। সেইমতো আমি দুপুর দুপুর চলে গিয়েছি। তখন অতটা কেউ আসে নি। তবে মেকআপ ম্যানরা এসে গিয়েছিল। আমিও সাত পাঁচ না ভেবে সামনের চেয়ারে বসে পড়েছিলাম। মেকআপ ম্যান কি বুঝলো কে জানে। আমি কি সাজব জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না। টেবিলে রাখা একটা মেকআপ টিউব থেকে একটুখানি ক্রিম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা মুখময় মেখে নাও তো ভালো করে। আমি যথারীতি তেমন করলাম। তারপর চোখ বুজিয়ে বসেছিলাম আধঘন্টাটাক। সেই চোখ বোজা অবস্থায় এটুকু বুঝতে পারছিলাম মেকআপ ম্যান আমার মুখে কত কি মাখিয়ে চলেছে। কি মাখাচ্ছে, কেন মাখাচ্ছে কিংবা আদৌ কিছু মাখাচ্ছে কিনা কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। দেখার দরকারও ছিল না। কেননা মেকআপ ম্যান তার দুই হাত দিয়ে যেভাবে আমার মুখটাকে আদর করছিল তাতেই আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল আমি এভাবে ঘাড়টা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে থাকতে পারি অমন আদর পেলে।
মেকআপ শেষ করে মেকআপম্যান যখন ছোট আয়নাটা আমার মুখের সামনে ধরল, আমি তো থ! এ কার মুখ! এটা আমি! নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। তবে আমার অবাক হওয়ার তখনও অনেক বাকী ছিল। মেকআপ শেষ হওয়া মাত্রই আমার ডাক পড়ল ড্রেস পরার জন্য। যথারীতি ড্রেসআপ ম্যানও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। সব যেন আগে থেকে ঠিক করা আছে। তাই চুপচাপ যন্ত্রবৎ কাজ করে চলেছেন। শুধু যাকে সাজানো হচ্ছে সে জানে না কি সাজছে। তার জিজ্ঞেস করারও জো নেই। মুখ ফুটে কিছু বলার জন্য একটু ঠোঁট ফাঁক করিছি কি করিনি, অমনি ধমক, উঁহু কথা নয়, মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। অগত্যা চুপ থাকা। এবং ড্রেসআপ ম্যানের নির্দেশ মতো সাজঘরেও চোখ বুজিয়ে দাঁড়ানো।
মিনিট দশেক পরে আমার তো চক্ষুস্থির। আমাকে এক দেবী সাজে সাজানো হয়েছে। নাম জানি না কোন্‌ দেবী। কিন্তু পরনের শাড়ি, আর মাথার মুকুট জানিয়ে দিচ্ছিল আমি এখন জীবন্ত কোন দেবী। অন্তত আজকের মেলা শেষ না হওয়া অবধি।
অস্বীকার করব না, সেদিন আমাকে অমন সাজে সাজানো ভালোই লেগেছিল। তখন ওই বয়সে আমার শরীরটা ছেলের মনটা মেয়ের এত অনুভুতি আসে নি। কিংবা হয়তো এসেছিল আমি বুঝতে পারি নি। না, না, নিশ্চয় এসেছিল। নইলে আমার মন যদি ছেলেদের মতো হত তাহলে আমার তো রেগে যাওয়ার কথা। কই সেদিন রাগ হয় নি তো। তবে এটা মনে আছে, আমি আসতে আসতে ড্রেসআপ ম্যান কাকুকে বলেছিলাম, কাকু, আমি তো মেয়ে নই, ছেলে। তবু আমাকে মেয়েদের মতো সাজালে কেন?
কাকু কি বুঝেছিল কে জানে। উলটে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এমন সেজে তোমার কি মন খারাপ করছে?
– নাঃ! তা করে নি। আমি মুখ ফুটে বলে ফেলেছিলাম।
-আমরা বুঝি। তাই তো সাজালাম। কাকু সুন্দর করে হেসে বলেছিল। আরও বলেছিল, যে যাই বলুক, কারও কথা শুনবে না। মন যেমন চাইবে তেমন সাজবে। মনে রাখবে শরীরটা তোমার, তাকে অন্য কেউ সাজিয়ে দেবে কেন? তুমিই তোমার মনের মতো করে এই শরীর সাজাবে। তারপর তা তুলে দেবে তোমার স্বপ্নের মানুষের হাতে।
-ও কাকু, কী সব কথা বলছ। বুঝতে পারছি না তো।
-বুঝবে বুঝবে, আর একটু বড় হও, সব বুঝবে। বলেই কাকু আর একজনকে ড্রেস পরাতে চলে গিয়েছিল।
কাকুর সেদিনের সব কথা বুঝি নি। মনেও থাকে নি। তবে ওই মন যেমন চাইবে তেমন সাজবে কথাটা খুব ভালো লেগেছিল। সেই ভালো লাগা নিয়ে চুপ করে বসেছিলাম সারা বিকেল। তারপর সন্ধ্যে নামলো। শুরু হল মেলা। ভ্যানে উঠে আমি স্ট্যাচু হয়ে দেবী ভঙ্গিমায় কিভাবে দাঁড়াব সেই কথা ভাবছিলাম, ঠিক তখনই আর একজন উঠে এল আমার ভ্যানে। রাজপুত্র সাজে। এসেই আমার ডানদিকে দাঁড়িয়েছিল মনে আছে। তারপর মেলা কমিটির কোন একজন এসে বলে গিয়েছিল, আমি নাকি মোহিনী আর আমার পাশে আমার স্বামী আরাবন।
সেদিন হাজার হাজার লোক আমাদের দেখেছিল। আর সবাই দেখবে ব’লে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে আমার হাত পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। তবু কষ্ট করে মুখ বুজে ছিলাম। মানুষ আমাদের দেখছে, দেখে ভালো বলছে। এমন প্রশংসা সব কষ্ট দূর করে দেয়। শুধু কি তাই! মেলা শেষে সাজার জন্য একটা পুরস্কারও দিয়েছিল।
আমি পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম হাসিমুখে। মেকআপ না তুলেই। ভেবেছিলাম, দেখব আমাকে কেউ চিনতে পারে কিনা। ও মা, আমাকে সবাই চিনে ফেলেছিল। এবং এই নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটিও হয়েছিল। আর মা উনুন থেকে জ্বলন্ত কাঠ বের করে পুড়িয়ে দিয়েছিল আমার হাত। মা এমনিতেই উঠতে বসতে মারতো। ভালোও বাসতো। কিন্তু মেলায় মেয়ে সাজানোর জন্য অমন হাত পুড়িয়ে দেবে ভাবতে পারিনি। তবে মায়ের কোন দোষ ছিল না। পাড়ার লোকেরা যখন তখন আমার নামে যা ইচ্ছা নয় তাই বলতো। মা কত সহ্য করতো বলুন তো। ওই যে মেলার দিন, মেলা উপলক্ষ্যে আমাদের বাড়ি আসা আমার মামিই তো মাকে শুনিয়ে বলেছিল, দিদি তোমার ছেলেটা এমনিতেই দিনদিন মেয়েলি হয়ে যাচ্ছে, তার উপর অমন মেয়ে সাজিয়ে আর লোক হাসিও না। তাই শুনেই মা মাথা গরম করে হাত পুড়িয়ে দিয়েছিল। মেয়ে সাজার আমার প্রথম পুরস্কার ছিল সেটা।

নানা জনের নানান কথা,
কেউ বোঝেনি মায়ের ব্যথা

ছেলেটা ছোট থেকেই মা ন্যাওটা ছিল। সবসময় আমার আঁচল ধরে ঘুরতো। ঘর-বার যাই করতাম পায়ে পায়ে পিছু নিত। কুটনো কুটি, রান্না করি, স্নানে যাই, শাড়ি পড়ি ও পাশে থাকতোই। আমিও থাকতে থাকতে ওকে পাশে খুঁজতাম। আর এটা ওটা ফাই ফরমাস করতাম। হাসিমুখে করেও দিত। বুঝতাম আমার ঘরকন্নার কাজ ওর খুব ভালো লাগতো। তাইতো সারাটা দিন রান্নাবাটি ছাড়া অন্যকিছু খেলতে চাইতো না। কিন্তু যখন একটু বড় হল, এই ধরুন ন’দশ বছর তখনো ঘর আর স্কুল, স্কুল আর ঘর। তখন কেমন যেন বিরক্ত লাগতো। যদিও ও আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। শাড়ির পাড় ধরা, কুটনো কেটে দেওয়া, আর ঘুমোনোর সময় আমার গলা না জড়িয়ে তো ঘুমোতোই না। তবু বিরক্তই লাগতো। কই আমার বড় ছেলেটা তো অমন নয়। বু খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পরেই ও কাছছাড়া, কোলছাড়া। আর ছোটটা যেন যত বড় হচ্ছিল তত বেশি করে কাছে আসছিল। শেষে বিকেল হলে, আমি জোর করে ওকে খেলতে পাঠাতাম। ছেলেদের মতো বাইরে। মাঠে। কিন্তু প্রায়দিন ছেলে আমার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতো। আর একটাই বুলি, ছেলেদের সঙ্গে আমার খেলতে ভালো লাগে না। ওরা পচা, ওরা বাজে। মা হয়ে ছেলে কাঁদলে, খেলতে না চাইলে কি করে জোর করতাম বলুন তো? তবু আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সবাই যখন বলতো, তোর ছোট ছেলেটা অমন কেন রে? সবসময় মেয়েদের সঙ্গে মিশতে চায়। হাঁটাটাও তো মেয়েদের দেখে নকল করে। আর যখন বসে পা মুড়ে, কোমর বেঁকিয়ে…ছি ছি। কিছু মনে কোরো না, তোমার জন্যই এমন হচ্ছে কিন্তু। তোমায় দেখেই শিখছে। ছোট ছেলে ব’লে এত আদর দিয়ে আঁচলে বেঁধে রেখো না। ছেলেকে ছেলেদের মতোই মানুষ করতে হয়। এসব কথা শুনতে শুনতে কান পচে যেত। রাগে ওকে মারতাম। বকতাম। আর ও বালিশে মুখ গুঁজে সারাদিন ঠোঁট ফুলিয়ে নাক টেনে কেঁদে যেতো। আমি তো মা, ছেলে কাঁদলে, না খেলে কি যে হয় একমাত্র মা-ই বোঝে। তবু ওর মুখ চেয়ে, ওকে ছেলেদের মতো করে গড়ে তুলতে ওর সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতাম না। ওকে আরও বেশি করে বকতাম। ও হয়তো ভাবতো ওর মা ওকে ভালোবাসে না। ওকে যে ওর ভালোর জন্যই বকতাম, মারতাম সেটা যদি বুঝতো ও নিজেকে পাল্টাতে চাইতো। কিন্তু লক্ষ্য করতাম, ও নিজেকে পাল্টাতে চেষ্টা না করে আরও জেদ করতো। খেতে বসলে ছেলেদের মতো বাবু হয়ে না বসে মেয়েদের পা দু’টো পাশে মেলে দিয়ে বসতো। সে জন্য কী মারটাই না খেত। কিন্তু অবাক হতাম, ও মুখে মুখে কোনদিন তর্ক করতো না। মার খেয়ে দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তো ভাতের থালায়। তাও মুখ বুজে খেয়ে যেতো। তবু একদিনও ওর দাদার মতো বাবু হয়ে খেতে বসতো না। মাঝে মাঝে মনে হত ও যেমন করে বসে খেতে চাই, খাক। কী এমন ক্ষতি তাতে। পরক্ষণেই মনে হত, না না, ওকে প্রশ্রয় দিলে ও আরো বেশি মেয়েলি আচরণ করবে। তাই আঁচলে মুখ চেপে আরও কঠোর হয়েছিলাম।
এভাবেই চলছিল। নানা জনের নানা কথা শুনতে শুনতে। শুনতাম, আর ব্যথায় টনটন করতো বুকখানি। ইচ্ছে করতো ওকে যে বুকের দুধ খাইয়ে বড়ে করেছি, সেই বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরি, হাপুস নয়নে কাঁদি। বাছা আমার প্রত্যেকটা দিন মার খেত। একটা দিনও আদর পেতো না।
কিন্তু একদিন এমন কান্ড করে বাড়ি ফিরেছিল রাগটা সেদিন আর দমিয়ে রাখতে পারি নি।
আমাদের গাঁয়ের মেলায় গাজন সাজতে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, ভালো হয়েছে, ছেলে একা একা বাইরে বের হতে শিখবে এইভাবে। কিন্তু সেজেছিল মেয়ে। ছোটবেলায় অনেক ছেলেকেই আদর করে মেয়ে সাজানো হয়। কিন্তু আমি জানতাম, আমার ছেলেকে ওরা আদর করে ভালোবেসে সাজায় নি। ওর গড়ন, ওর চালচলন একটু মেয়েলি ছিল বলে ব্যঙ্গ করতেই তেমন সাজিয়েছিল। একটা মায়ের কাছে এটা কতখানি ব্যথার তা অন্য কেউ বুঝবে না। আমি বোঝাতেও পারবো না। তাইতো সেই ব্যথার রাগে সেদিন আমার ছেলেটার হাতটা উনুনের জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। ও মা গো, মা গো, বলে চিৎকার করে উঠেছিল, আর আমি মা হয়ে সেদিন ওকে বলেছিলাম, আজ থেকে আমি তোর মা নই।


লিপস্টিক দিয়ে খেলাম চড়
শরীর জুড়ে এল যে জ্বর

 

মামার ছেলের জন্মদিন না অন্য কি একটা অনুষ্ঠান ছিল। আমাদের সবার নিমন্ত্রণ। কিন্তু বাবা কাজে যাবে, যেতে পারবে না। দাদার সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। কোচিং বা স্কুল কামাই করতে পারবে না। তাই যাবে না। যাওয়ার মধ্যে ছিলাম আমি আর মা। আমি তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। আমার একদিন স্কুল ছুটি করলে কিচ্ছু অসুবিধে নেই। কিন্তু সকাল থেকেই আমার শরীরটা খারাপ। বমিও হয়েছিল মনে হয়। আমার তো তখন একটু কিছু হলেই বমি হত। কত লোকের যেমন ঠান্ডার হাত, আমার তেমন বমির ধাত। আর বমি হলে কি বলো তো শরীরটা খুব হালকা হয়ে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। এদিকে মা আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। যাওয়াটা বন্ধ করে দেবে, নাকি অসুস্থ হওয়া স্বত্ত্বেও আমাকে সঙ্গে নিয়েই যাবে। অবশ্য আমার এমন কিছু শরীর খারাপ করে নি। যাওয়া যেতেই পারতো। কিন্তু মামার বাড়ি যাওয়াটা আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। শুধু মামার বাড়ি কেন, কোন আত্মীয় বাড়ি যেতেই আমার ভালো লাগতো না। মা সেটা জানতো। তাই মা বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল সেদিন। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাকে লক্ষ্য করছিলাম। মা ইতস্তত ভাব নিয়েই টুকিটাকি কাজ সারছিল। শেষে আমিই সমস্যাটার সমাধান করে দিয়েছিলাম। মাকে ডেকে বলেছিলাম, তুমি একাই যাও না। ঘুরে এসো। আমার কোন অসুবিধে হবে না।
মা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। আসলে আমি মাকে এমনিতেই সারাক্ষণ আঁকড়ে থাকতাম। আর শরীর খারাপ হলে তো একেবারে কাছ ছাড়া করতাম না। বিরক্ত হলেও মাও আমার কাছ থেকে যেতে পারতো না, সেই মা দেখল, আমি নিজে থেকে বলছি, আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমার এমন কথা শুনে মা খুশিই হয়েছিল। খুব মনে আছে, মা তখন পাশে বসে আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেছিল, এই তো ছেলে আমার বড় হয়ে গিয়েছে।
–কি করে বুঝলে আমি বড় হয়ে গিয়েছি। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম।
–বা রে, বড় না হলে কেউ মাকে ছেড়ে একা একা থাকতে চায় না। বলেই মা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। হয়তো ভেবেছিল আর কিছুক্ষণ থাকলেই যদি আমি আমার মত পালটে ফেলি। যদি বলি, আমি এক্ষুনি বড় হতে চাই না মা…। এর আগে তো কতবার অমন করেছি। মা আমার ঘর ছেড়ে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিন বলেছিল, তাহলে আমি তোর মতো রান্না করে রেখে যাচ্ছি। শুধু নিয়ে খেয়ে নিস।
তারপর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই মা রেডি হয়ে আমার মাথায় আর একবার হাত বুলিয়ে চলে গিয়েছিল মামার বাড়ি। আমি মনে হয় তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ বালিশ আঁকড়ে শুয়েছিলাম। শুয়ে শুয়ে কত কি ভাবছিলাম। হঠাৎ মনে পড়েছিল, ড্রেসআপ ম্যান কাকুর কথা। মন যেমন চাইবে তেমন করে সাজাবে। আমার মন কি চাই? কিরকম সাজতে ভালোবাসে?
মন কি চায়, জানার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলাম মায়ের ড্রেসিং টেবিলের সামনে। পেট থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায় এমন একটা আয়না ফিটিং ছিল সেই ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গে। সেই আয়নায় নিজেকে দেখেছিলাম অনেকক্ষণ। নিজের ভ্রু, চোখ, নাক, ঠোঁট , চিবুক, গলা স-অ-ব দেখছিলাম। দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই গায়ের জামাটা কখন খুলে ফেলেছিলাম খেয়াল ছিল না। শুধু হঠাৎ মনে হল, আয়নার ওপারে নগ্ন যে দাঁড়িয়ে ছিল সে একটা ছেলে নয়, মেয়ে। সত্যিকারের মেয়ে। নইলে তার অমন কুসুম কুসুম বুক হবে কেন। এর আগে মায়ের বুক দেখেছি। লুকিয়ে লুকিয়ে। নিজের বুকেও ছোট্ট হলেও অমন বুক উঠতে দেখে মনে হয়েছিল, আমিও তাহলে মায়ের মেয়ে।
দেখামাত্রই আমি পাগলপারা। শুধু মনে হচ্ছিল, এই জন্য এতদিন আমার মেয়েদের সবকিছু ভালো লাগতো। সেদিন ছুটে গিয়ে দরজা জানলা বন্ধ করেছিলাম। পুরো বাড়ি ফাঁকা। ঘরে কেউ নেই। তবু কেউ যদি দেখে ফেলে, কিংবা কেউ হঠাৎ এসে পড়ে…।
বন্ধ করেই আলনা থেকে মায়ের একটা শাড়ি পেরে নিয়েছিলাম।
ছোট থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের শাড়ি পরা দেখতাম। পাড় ধরে দিতাম। কেমন করে চোখে কাজল দিত, কপালে টিপ পরত, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতো সব দেখতাম। ড্যাব ড্যাব করে। মা বকতো। তবু আমি দেখতাম।
তাই অনায়াসেই মায়ের শাড়িটা পেঁচিয়ে নিলাম সারা শরীরে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা মায়ের কাজল দিলাম চোখে। টিপের পাতা থেকে একটা লাল টিপ খুলে লাগালাম কপালে। তারপর লিপস্টিক দিয়ে রাঙিয়েছিলাম আমার ঠোঁট। তারপর দুচোখ তুলে দেখি, আয়নার ওপারে এক কিশোরীই দাঁড়িয়ে।
হঠাৎ বাইরের দরজায় ঠক ঠক ঠক। আমি তো ভয়ে কাঁটা। এমন দুপুরে কারও তো আসার কথা নয়। আবার ঠক ঠক। সঙ্গে চিল চিৎকার, ওই সমু দরজা খোল্‌। দাদার গলা। দাদা এখন? কি করি এবার। তাড়াহুড়ো করে শাড়িটা খুলে জামাটা পরতে পরতেই ছুটেছিলাম দরজা খুলতে। খেয়াল ছিল না রাঙানো ঠোঁটের লিপস্টিক মোছা হয় নি।
দরজা খোলামাত্রই দাদা আমাকে দেখে আগুন হয়ে গিয়েছিল। কোন কথা না বলে দু’গালে ঠাস ঠাস করে চড় কসিয়ে দিয়েছিল। তারপর চুলের মুঠি ধরেও উদ্দুমুদ্দুম। আমি কিচ্ছু বলি নি। মুখ বুজে মার খেয়ে যাচ্ছিলাম। আসলে ছোট থেকে মা বাবা দাদা সবাই একটু কিছু হলেই আমাকে মারতো। আমি যেন মার খাওয়ার জন্যই জন্মেছিলাম। খেতামও। খেতে খেতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সহ্যও হত। আগে চিৎকার করতাম। একটু বড় হওয়ার পর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হত না। শুধু চোখ দিয়ে জল ঝরতো।
দাদা বেশ কিছুক্ষণ মেরে মেরে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। আমিও কোনরকমে উঠে নিজের বিছানায় যেতে পেরেছিলাম। তবে এত মার খেয়েছিলাম যে উঠে ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হয় নি। অবশ্য ওঠার শক্তিও ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জানি না। যখন চোখ খুলেছিলাম, বুঝলাম আমার সারা শরীর আগুন। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। আসতে আসতে আমার দুপুরের ঘটনা মনে পড়েছিল। জিভ বের করে ঠোঁটে বুলোতে বুলোতে বুঝেছিলাম, শুকনো ঠোঁটেও লিপস্টিকের দাগ লেগেছিল।


চেয়েছিল ভাই ফোঁটা দিতে,
পারি নি আমি মেনে নিতে

ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তেই জীবন বিজ্ঞানে পড়েছিলাম লিঙ্গ নির্ধারণের অধ্যায়। দেহ ক্রোমোজোম, সেক্স ক্রোমোজোম। এক্স ওয়াই থাকলে ছেলে। এক্স এক্স মানে মেয়ে। আর এক্স এক্স ওয়াই কিংবা এক্স ওয়াই ওয়াই এরকম কিছু থাকলে ছেলেও নয়, মেয়েও নয়। স্যার বলেছিলেন এরাই তৃতীয় লিঙ্গ। একেবারে জলের মতো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওসব ক্রোমোজোম টোমোজোম তো বাইরে থেকে দেখা যায় না। খালি চোখে কি দেখে বুঝবো কে তৃতীয় লিঙ্গ! বিজ্ঞান স্যার একটুতেই যা রেগে যেতেন ওসব জিজ্ঞেস করার সাহসই হত না। জানতে চাইলে হয়তো বলে দিতেন, বাইরে থেকে দেখে বোঝার জিনিস বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান হল গবেষণা। তাই ওসব আজগুবি প্রশ্ন না করে মন দিয়ে মুখস্থ করো।
আমার মনে হয়, উনিও বাইরে থেকে দেখে কিছু বুঝতে পারতেন না। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই আমার ভাই তৃতীয় লিঙ্গ ছিল আর ভাইও তো আমার স্কুলেই পড়তো, বিজ্ঞান স্যার ওদেরও ক্লাস নিত, কই স্যার তো ভাইকে দেখে কিচ্ছু বলতেন না। বুঝতে পারলে নিশ্চয় চুপ থাকতেন না।
আমি তো ভাইকে ছোটবেলায় ন্যাংটো দেখেছি। ভাই পুরোপুরি আমার মতোই ছিল। মোটেও তৃতীয় লিঙ্গ ছিল না। একটা ক্রোমোজোম বেশি কিংবা কম হলে ভাইয়ের ওখানটা একটু তো আলাদা হত নাকি! কি জানি, বিজ্ঞান নাকি যা বলে সত্যি বলে। কিন্তু বিজ্ঞানের সেই সত্যি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করি কি করে?
হ্যাঁ, তবে এটা ঠিক, ভাইয়ের হাঁটাচলা, কথা বলা, ওঠা বসা একটু অন্যরকম ছিল। আর ছেলেদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতো না। আমরা ছেলেরা যেমন ঝগড়া, মারামারি পছন্দ করি ও ওসব পছন্দ করতো না। ও মেয়েদের মতো পুতুল খেলা, রান্নাবাটি খেলা, ঘর সাজানো এসব খেলতে চাইতো। কিন্তু মেয়েরা ওকে নেবে কেন? নিতও না। উলটে বলত, যা দিনি এখান থেকে। ছেলে হয়ে মেয়েদের কাছে আসিস কেন? তুই ওদের মতো ফুটবল খেলতে পারিস না?
কিন্তু ভাই ফুটবল না খেলতে এসে মেয়েদের সঙ্গে বউ বাসুন্তী খেলতে চাইতো। বউ সেজে উবু হয়ে বসে থেকে কী আনন্দ পেত ওই জানে। মেয়েরা ওকে তাড়িয়ে দিলেও এক আধদিন খেলতে নিত। বিশেষ করে যেদিন মেয়ে কম থাকতো।
অস্বীকার করব না ওসব দেখে আমার রাগই হত। ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো উবু হয়ে দুই হাঁটু জড়িয়ে বসত আর থুনতিটা রাখতো ওই হাঁটুর উপর। ওরকম দেখলে কার না রাগ হবে! নিজের ভাই বলে আমি তবু মেনে নিতাম। কিন্তু আমার বন্ধুরা? আমাদের পাড়ার ছেলেরা? সব্বাই ওকে দেখে হা হা হি হি করতো। এরপরে রাগ না করে থাকা যায়?
মা তো এ জন্য প্রায়ই ওকে মারতো। কিন্তু ও এমন গাধা মার খেয়ে খেয়েও একটুও নিজেকে পাল্টাতে চাইতো না। চেষ্টাই করতো না। উলটে একদিন বাড়িতে কেউ ছিল না, সেই সুযোগে এমন কান্ড করেছিল, মনে পড়লে এখনো আমার গা রি রি করে ওঠে। মায়ের লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে মেয়ে সেজেছিল। শাড়িও পরেছিল মনে হয়। মায়ের ঘরে মেঝেতে সেদিন শাড়ি পরে থাকতে দেখেছিলাম। তো যাই হোক, সেদিন ভাইয়ের অমন লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারি নি। খুব মেরেছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, ওভাবে মারা ঠিক হয় নি। তবু রাগের বশে না মেরে থাকতেও পারি নি। আসলে ও যদি নিজেকে শুধরোতে একটু চেষ্টা করতো তাহলে অমন মার খেত না। কিন্তু ও সেই চেষ্টা একদিনও করে নি। করলে ওকে সবাইই ভালোবাসতো।
চেষ্টা তো দূরের কথা। অমন মার খাওয়ার পরের বছর, আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। আমার কোন বোন নেই বলে, কলেজে থার্ড ইয়ারের একজনকে দিদি পাতিয়েছিলাম, তো ভাইফোঁটার দিন সেই দিদির বাড়ি যাব বলে বের হচ্ছিলাম, ভাই এসে বলে কিনা আমায় ফোঁটা দেবে। ও নাকি আমার বোন। শুনে মারবো বলে হাতও তুলেছিলাম। তবে ওই দিনে মুডটা খারাপ করতে চাই নি বলে মারি নি। শুধু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলাম। না দিয়ে কোন উপায়ই ছিল না। ভাই কে কি কখনো বোন বলে মেনে নেওয়া যায়? যায় না।

 

চলবে…..

Loading

One thought on “আয়নামহল (পর্ব-১)

  1. বাহ, খুব সুন্দর হচ্ছে, একদম নতুন বিষয় নিয়ে লেখা, পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম…

Leave A Comment